Sunday, 21 August 2016

বাংলা রচনা সমগ্র
                                                                  অধ্যবসায়
(সংকেত: সূচনা; অধ্যবসায় কী; অধ্যবসায়ের প্রয়োজনীয়তা; ছাত্রজীবনে অধ্যবসায়ের গুরুত্ব; ব্যক্তিজীবনে অধ্যবসায়ের গুরুত্ব; জাতীয় জীবনে অধ্যবসায়ের গুরুত্ব; প্রতিভা ও অধ্যবসায়; অধ্যবসায়ীর দৃষ্টান্ত; অধ্যবসায়হীনের অবস্থা; উপসংহার।)
সূচনা: জীবনে সফল হতে চাই একাগ্রতা ও নিষ্ঠা। সফলতার পথের প্রথম এবং অনিবার্য শর্ত হলো অধ্যবসায়। অধ্যবসায় ছাড়া ব্যক্তি জীবন কিংবা জাতীয় জীবন কোনো ক্ষেত্রেই সফলতা কল্পনাও করা যায় না। একমাত্র অধ্যবসায়ের বলেই মানুষ জীবনে চলার পথের সকল বাধা-বিপত্তি মোকাবেলা করে সফলতার শীর্ষে আরোহন করতে পারে।
অধ্যবসায় কী: যে কোনো কাজেই সফলতা ও ব্যর্থতা এ দু’টিই আসতে পারে। জীবনে সব কাজেই মানুষ প্রথমবারেই সফল হবে এমন নয়। কোনো কোনো কাজে প্রথমবার, এমনকী দ্বিতীয়, তৃতীয় বারেও সফলতা নাও আসতে পারে। কিন্তু তাই বলে ব্যর্থতাকে মেনে নিয়ে, হতাশ হয়ে, থেমে থাকলে চলবে না। বরং ধৈর্য ও নিষ্ঠার সাথে সফলতা না আসা পর্যন্ত চেষ্টা করে যেতে হবে। এরই নাম অধ্যবসায়। এ প্রসঙ্গে কবি যথার্থই বলেছেন-
‘পারিব না এ কথাটি বলিও না আর,
একবার না পারিলে দেখ শতবার।’
অধ্যবসায়ের প্রয়োজনীয়তা: পবিত্র হাদিস শরীফে বর্ণিত আছে- ‘যে চেষ্টা করে সেই পায়’। হাদিসের এই বাণী থেকেই একথা সুস্পষ্ট যে, মানবজীবনে অধ্যবসায়ের বিকল্প নেই। প্রতিটি ধর্মেই অধ্যবসায়কে মানুষের মহৎ গুণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। পৃথিবীতে যা কিছু মহান, যা কিছু কল্যাণকর তা সবই অধ্যবসায়ের গুণে অর্জিত হয়েছে। অধ্যবসায় মানব সভ্যতার অগ্রগতির প্রথম সোপান। আদিম সভ্যতার বন্য মানুষ বর্তমানে বিজ্ঞান শিক্ষায় শিক্ষিত আধুনিক মানুষ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে মূলত অধ্যবসায়ের গুণেই। অধ্যবসায়ের গুণেই মানুষ যুগে যুগে জয় করেছে মহাসাগরের অতলগর্ভ, সুউচ্চ পর্বতশৃঙ্গ, এমনকী মহাকাশও। জীবনে চলার পথে প্রতি পদক্ষেপে যে ব্যক্তি অধ্যবসায়ের পরিচয় দিতে পারে সেই সফল। সুতরাং মানব জীবনে অধ্যবসায় অপরিহার্য।
ছাত্রজীবনে অধ্যবসায়ের গুরুত্ব: ছাত্রজীবন ব্যক্তির মানস গঠনের শ্রেষ্ঠ সময়। পরবর্তী জীবন সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হবার উপযুক্ত সময় এই ছাত্রজীবন। তাই ছাত্রজীবনে অধ্যবসায়ের গুণ আয়ত্ত করা সর্বাপেক্ষা প্রয়োজনীয়। অধ্যবসায় ব্যতীত ছাত্রজীবনে সাফল্য অর্জন করা সম্ভব নয়। অলস ও শ্রমবিমুখ ছাত্র-ছাত্রী যতই মেধাবী হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত সে বিদ্যার্জনে সফলতা লাভ করতে পারে না। অন্যদিকে একজন অধ্যবসায়ী ছাত্র বা ছাত্রী স্বল্প মেধাসম্পন্ন হলেও ভালো ছাত্র হিসেবে নিজের কৃতিত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সফল হয়। ইংরেজিতে একটা প্রবাদ আছে- ‘Failure is the pillar of success’ ব্যর্থ না হলে সফলতার মর্ম বোঝা যায় না। তাই একবার অকৃতকার্য হলে হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দেওয়া বোকামি বরং অধ্যবসায়ের দ্বারা লক্ষ্য অর্জনের দিকে এগিয়ে যাওয়া উচিত।
ব্যক্তিজীবনে অধ্যবসায়ের গুরুত্ব: প্রতিটি মানুষই ব্যক্তিজীবনে সাফল্য কামনা করে। কিন্তু জীবনে সহজেই সাফল্য আসে না। সাফল্য অর্জনের পথে মানুষকে প্রতিনিয়ত নানারকম বাধার সম্মুখীন হতে হয়। কোনো মানুষের জীবনই নিরবিচ্ছিন্ন সুখের নয়। জীবনে কষ্ট আছে, হতাশা আছে, ব্যর্থতা আছে। এসব দুঃখ-বেদনা-হতাশা-ব্যর্থতাকে ঝেড়ে ফেলে যে ব্যক্তি লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যায় সে-ই সফল হতে পারে। কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার তা-ই বলেন-
‘কেন পান্থ ক্ষান্ত হও, হেরি দীর্ঘ পথ
উদ্যম বিহনে কার পুরে মনোরথ?’
কেবলমাত্র অধ্যবসায়ী ব্যক্তিরাই নিষ্ঠা এবং কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে সফলতার স্বর্ণচূড়া স্পর্শ করতে পারে। তাই ব্যক্তিজীবনে অধ্যবসায়ী হওয়া প্রত্যেক মানুষের জন্যই একান্ত আবশ্যক।
জাতীয় জীবনে অধ্যবসায়ের গুরুত্ব: প্রবাদ আছে- ‘রোম নগরী এক দিনে তৈরি হয়নি।’ প্রতিটি জাতির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে এসব জাতির গোড়াপত্তন এবং অগ্রগতির পেছনে আছে শত সহস্র বছরের অসংখ্য মানুষের যুগ-যুগান্তরের সাধনা। প্রকৃতপক্ষে, একটি দেশ বা জাতির উন্নতির জন্য ঐ জনগোষ্ঠীর সকল নাগরিকেরই অধ্যবসায়ী হওয়া একান্ত প্রয়োজন। কোনো একটি জাতিগোষ্ঠীর প্রত্যেক নাগরিক যখন ব্যক্তিজীবনে অধ্যবসায়ী হয়ে উঠবে তখন ঐ জাতির উন্নতি অবশ্যম্ভাবী। পৃথিবীর উন্নত রাষ্ট্রগুলোর দিকে তাকালে দেখা যাবে যে, সেসব দেশের প্রায় সকল নাগরিকই অধ্যবসায়ী। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জাপান, মালয়েশিয়ার মতো প্রথম সারির দেশগুলোর উন্নতির মূলমন্ত্র অধ্যবসায়। কেবলমাত্র অধ্যবসায়ের গুণেই এসব দেশ উন্নতির শীর্ষে অবস্থান করছে।
প্রতিভা ও অধ্যবসায়: কিছু মানুষ মনে করে যে, প্রতিভার বলে অসাধ্য সাধন করা যায়। কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাসে এ পর্যন্ত যারাই কীর্তিমান বলে পরিচিতি লাভ করেছেন তাঁরা নিজেদের প্রতিভার চেয়ে অধ্যবসায়ের প্রতি বেশি জোর দিয়েছেন। বিজ্ঞানী নিউটন এ প্রসঙ্গে বলেন-‘আমার আবিষ্কারের কারণ প্রতিভা নয়, বহু বছরের চিন্তাশীলতা ও পরিশ্রমের ফলে দুরুহ তত্ত্বগুলোর রহস্য আমি ধরতে পেরেছি।’ অন্যদিকে ডালটন বলেন- ‘লোকে আমাকে প্রতিভাবান বলে, কিন্তু আমি পরিশ্রম ছাড়া কিছুই জানি না।’ সৃষ্টিকর্তা প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই কম-বেশি প্রতিভা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন কিন্তু এই প্রতিভা মানব মনে সুপ্ত অবস্থায় থাকে। এই সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে অধ্যবসায় অনিবার্য। এমন বহু দৃষ্টান্ত আছে যে, অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী হয়েও শুধুমাত্র অধ্যবসায়ের অভাবে ব্যর্থতাকেই বরণ করে নিতে হয়েছে। ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ার যথার্থই বলেছেন- ‘প্রতিভা বলে কিছু নেই। পরিশ্রম ও সাধনা করে যাও, তাহলে প্রতিভাকে অগ্রাহ্য করতে পারবে।’ প্রতিভার সঙ্গে অধ্যবসায় যুক্ত হলেই অসাধ্য সাধন করা সম্ভব। অধ্যবসায় না থাকলে প্রতিভা মূল্যহীন হয়ে পড়ে।
অধ্যবসায়ীর দৃষ্টান্ত: ঘাত-প্রতিঘাতময় জীবন সংগ্রামে সাফল্যের মূলমন্ত্র হলো অধ্যবসায়। বিশ্ব ইতিহাসের পাতা উল্টালে অনুস্মরণীয় অসংখ্য অধ্যবসায়ীর দৃষ্টান্ত চোখে পড়ে। স্কটল্যান্ডের রাজা রবার্ট ব্রুসের জীবন অধ্যবসায়ের একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। তিনি ইংরেজদের সাথে যুদ্ধে একে একে ছয় বার পরাজিত হয়েও জয়ের আশা ত্যাগ করেননি। বরং পুনরায় সৈন্য সংগ্রহ করে সপ্তম বারের মতো যুদ্ধে যান এবং জয়ী হয়ে হৃতরাজ্য ফিরে পেয়েছিলেন। এমনিভাবে, ইসলাম ধর্মের প্রচারক হযরত মুহম্মদ (স.) সত্যধর্ম প্রচারে বারবার বাঁধা ও নির্যাতনের শিকার হলেও তিনি হাল ছেড়ে দেননি। বরং কঠোর অধ্যবসায়ের বলে তিনি ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে সফল হয়েছিলেন। অন্যদিকে গ্রীসের বাগ্মীপ্রবর ডিমস্থিনিয়া প্রথম জীবনে তোতলা ছিলেন। স্বীয় অধ্যবসায়ের বলে পরবর্তীতে তিনি গ্রীসের বিখ্যাত বক্তা হিসেবে সুখ্যাতি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আবার মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবর প্রথম জীবনে রাজ্য থেকে নির্বাসিত হলেও পরবর্তীতে অদম্য অধ্যবসায়ের বলে তিনি সমগ্র ভারতবর্ষের সম্রাট হতে পেরেছিলেন। অর্ধ-পৃথিবীর অধিশ্বর নেপোলিয়ান বোনাপার্ট তাঁর জীবনালেখ্যের মাধ্যমে অধ্যবসায়ের অপূর্ব নিদর্শন রেখে গেছেন। তিনি বলেছেন- “Impossible is a word which is found only in the dictionary of a fool.” অন্যদিকে স্রষ্টার সৃষ্টির দিকে তাকালে দেখা যায় কেবল মানুষই নয়, সামান্য পতঙ্গের মধ্যেও অধ্যবসায়ের গুণটি উপস্থিত। সমস্ত প্রাণীজগতের মধ্যে সর্বাপেক্ষা ক্ষুদ্র যে পিপঁড়া, তার মধ্যেও নিরলস পরিশ্রম এবং অধ্যবসায়ের নিদর্শন চোখে পড়ে।
অধ্যবসায়হীনের অবস্থা: প্রবাদ আছে- ‘অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা’। অধ্যবসায়হীন, শ্রমবিমুখ ব্যক্তিরা কেবলমাত্র দেশ ও জাতির অন্ন ধ্বংস করতে পারে। অধ্যবসায়হীন ব্যক্তি কেবল নিজের জন্যই নয়, সমগ্র জাতির জন্য ক্ষতির কারণ। অধ্যবসায় না থাকলে ছাত্রজীবন, ব্যক্তিজীবন, জাতীয় জীবন, কোনো ক্ষেত্রেই সাফল্য লাভ করা যায় না। ফলে কোনো কাজেই সফলতা অর্জন করতে না পেরে অধ্যবসায়হীন ব্যক্তির জীবন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় এবং সর্বোপরি সে সমাজের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়।
উপসংহার: মানুষ স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। কেবল কথায় নয়, কাজের মধ্য দিয়ে মানুষকে এই শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় দিতে হয়। আর এ জন্যে সর্বাগ্রে যে গুণটি আয়ত্ত করা প্রয়োজন তা হলো অধ্যবসায়। প্রত্যেক মানুষের মনে রাখা উচিত আল্লাহ তাদেরই সাহায্য করেন, যারা অধ্যবসায়ী এবং পরিশ্রমী। তাই সফলতার পথে এগিয়ে যেতে আমাদের সবাইকে হতে হবে অদম্য অধ্যবসায়ী।

No comments:

Post a Comment